মুহা. ফখরুদ্দীন ইমন: আহা! কী সুন্দর, মনোমুগ্ধকর অপরূপ দৃশ্য। উপরে নীল-সাদা আসমান আর নিচে সবুজ ঘাসে মোড়ানো এক টুকরো জমিন। সবুজাবৃত মাঠের চারিধারে অসাধারণ স্থাপনা গুলো নক্ষত্রের মত জ্বলজ্বল করছে। এ যেন শিল্পীর মনের মাধুরী মিশিয়ে আঁকা চোখ ধাঁধানো কোন রূপ কথার গল্পের স্বপ্নীল ছবি। স্থাপনাগুলোকে কাছ থেকে দেখে বিদেশি কোনো পর্যটন এলাকা কিংবা দর্শনীয় কোনো স্থাপনাও ভাবতে পারেন অনেকে। তবে বাস্তবতা হলো ভিন্ন। প্রকৃতপক্ষে এটি একটি বিদ্যালয় ক্যাম্পাস। না, দেশের বাইরের কোনো জায়গায় নয়, দেশের রাজধানী কিংবা উন্নত কোনো শহরেও নয়। বাংলাদেশের-ই ঐতিহ্যবাহী ও উল্লেখযোগ্য স্থান কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রামে এর অবস্থান। মহাসড়কের পাশে এর অবস্থান হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থাও অত্যন্ত ভালো। যেকোন জায়গা থেকেই শিক্ষার্থীরা যাতায়াত করতে পারে খুব সহজেই। এ বিদ্যালয়ের ভবনগুলো সত্যিই অসাধারণ। সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা গুলো বাড়িয়ে দিয়েছে এর সৌন্দর্য্য। দিনে সূর্য আর রাতে চাঁদের আলোতে জ্বলজ্বল করে ভবনগুলো।
স্থানীয়দের মতে, বিদ্যালয়ের ভবন ও অবকাঠামো গুলো ইউরোপিয়ান স্টাইলে তৈরিকৃত। নান্দনিক ডিজাইন ও নানা কারুকাজে সজ্জিত ভবনগুলোতে রয়েছে প্রশস্ত সিঁড়ি, বারান্দা ও পর্যাপ্ত পরিমান পরিচ্ছন্ন-জীবানুমুক্ত ওয়াশরুম। শ্রেণিকক্ষগুলোও ব্যতিক্রমী আসবাবে দারুণভাবে সাজানো ও পরিপাটি। রয়েছে প্রজেক্টরের মাধ্যমে পাঠদানের ব্যবস্থা। বিদ্যালয় ভবনের দ্বিতীয় তলায় ছাত্রীদের জন্য স্থাপন করা হয়েছে অত্যাধুনিক কম্পিউটার ল্যাব, সায়েন্স ল্যাব, গ্রন্থাগার। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে আধুনিক প্লে-রুম। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য রয়েছে সু-বিশাল হল রুম (অডিটরিয়াম)। নামাজের জন্য রয়েছে আলাদা আরেকটি পরিপাটি কক্ষ। সেখানে আরবী শিক্ষকের (মহিলা) ইমামতিতে শিক্ষিকা-ছাত্রীরাও নামাজ পড়েন বেশ স্বতস্ফুর্তভাবে। সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ নিশ্চিতের জন্য নিয়মিত বিদ্যুৎ ব্যবস্থার পাশাপাশি রয়েছে সোলার সিস্টেম ও আইপিএস সিস্টেম। ক্লাস মনিটরিং এর জন্য শ্রেণী কক্ষে সিসিটিভির ব্যবস্থা রয়েছে। ভবনগুলোর বাহিরের চারপাশে নিরাপত্তা প্রাচীরসহ সিটিটিভি ও নিরাপত্তা প্রহরী রয়েছে। প্রায় পঞ্চাশটির অধিক সিসিটিভি ক্যামেরা দ্বারা সার্বক্ষণিক সার্বিক পরিস্থিতি মনিটর করা হয়। রয়েছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বিনোদন-খেলাধুলার জন্য মাঠ ও নানা রকমের খেলা সরঞ্জাম। বিদ্যালয় মাঠের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে সীমানা প্রাচীরের সঙ্গে রয়েছে একটি শহীদ মিনার। সব মিলিয়ে অসাধারণ ও ব্যতিক্রমী একটি বিদ্যালয় ক্যাম্পাস। সবার জন্য উন্মুক্ত না থাকলেও আগ্রহীরা চাইলে কর্তৃপক্ষের অনুমতি স্বাপেক্ষে ক্যাম্পাসটি ঘুরে দেখতে পারবেন
সৈয়দা আঞ্জুমান আরা বালিকা বিদ্যালয় সত্যিই চৌদ্দগ্রামের একটি ব্যতিক্রমী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অপরূপ সৌন্দর্য্যরে লীলাভূমি খ্যাত উপজেলার জগন্নাথদীঘি ইউনিয়নে অবস্থিত কুমিল্লার সর্ববৃহৎ ও ঐতিহ্যবাহী জগন্নাথদীঘির পাশ ঘেষে বয়ে চলা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পশ্চিম পাশে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক, মনোরম ও নান্দনিক পরিবেশে গত বছর (২০১৮ সালে) প্রতিষ্ঠিত এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি কার্যক্রমে রয়েছে আধুনিকতা ও ভিন্নতার ছায়া। আঞ্জুমান আরা মুজিব ট্রাস্ট্রের পরিচালকদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও শিক্ষানুরাগি মো. মাহবুবুর রহমান বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। ট্রাস্ট পরিচালকদের সর্বসম্মতি, এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের অনুরোধক্রমে উপজেলা শিক্ষা অফিসের নীতিমালা অনুস্মরণ ও সুনির্দিষ্ট একটি প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে শিক্ষানুরাগি মো. মাহবুবুর রহমান বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। জানা যায়, ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে তৎকালিন বানিজ্য মন্ত্রী মো. তোফায়েল আহমেদ ও চৌদ্দগ্রামের সাংসদ, সাবেক রেলপথমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক এমপি আনুষ্ঠানিকভাবে বিদ্যালয়টির শুভ উদ্বোধন করেন। আধুনিক ও নৈতিক শিক্ষার সমন্বয় এবং উন্নত বিশ্বের অনুকরণে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি তার ব্যতিক্রমী উদ্যোগ ও কার্যক্রমের জন্য ইতিমধ্যেই উপজেলাসহ কুমিল্লা জেলায় বেশ আলোচিত। মাত্র এক বছরেই উপজেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুনাম কুড়াতে সক্ষম হয়েছে। উন্নত ব্যবস্থাপনা ও সুযোগ-সুবিধার খবর ছড়িয়ে পড়লে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নসহ পাশ্ববর্তী উপজেলাগুলো থেকেও ছাত্রীরা ভর্তি হওয়ার জন্য ছুটে আসছে। মাত্র ৮০ জন্য ছাত্রী নিয়ে এই বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে ২৪৪ জন ছাত্রী রয়েছে।
এখন পর্যন্ত বিদ্যালয়ের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা না থাকলেও অধ্যক্ষ ও কর্তৃপক্ষের সার্বিক সহযোগিতায় এবং অভিভাবকদের উদ্যোগে দূরবর্তী ছাত্রীদের বিদ্যালয়ে আনা নেওয়ার জন্য কয়েকটি প্রাইভেট পরিবহন এর সু-ব্যবস্থা করা হয়েছে। ক্লাস চলাকালীন সময়ে অপেক্ষমান অবিভাবকদের জন্য মূল ফটকের দক্ষিণ পার্শে রয়েছে পরিপাটি দু’টি ওয়েটিং রুম। নবীন-প্রবীন মিলিয়ে সতের জন শিক্ষক পাঠদানে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের খেলাধুলা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার ছিনিয়ে এনেছে এই বিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রীরা। থাকা খাওয়ার জন্য বিদ্যালয়ের ভিতরে ছাত্রী ও শিক্ষিকাদের জন্য রয়েছে আবাসিক সুবিধা। রয়েছে অত্যাধুনিক ও নিরাপদ খাদ্য সমৃদ্ধ ক্যান্টিন। বর্তমানে প্রথম শ্রেণী থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত চালু থাকলেও পর্যায়ক্রমে বিদ্যালয়টি একদিন কলেজে রুপান্তরিত হবে সকল অবিভাবকসহ কর্তৃপক্ষের প্রত্যাশা।
বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মেহের মুকবুলা বলেন, “প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিদ্যালয়ের সুনাম এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। পড়ালেখার মান উন্নয়নসহ সকল কার্যক্রমে ভালো কিছু উপহার দিতে বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটি ও স্থানীয়দের সহযোগিতায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। নারীদের সুশিক্ষা নিশ্চিতের প্রত্যয় নিয়ে প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যাপিঠকে উপজেলার সীমানা ছাড়িয়ে জেলা তথা দেশের শিক্ষা আঙ্গিনায় একটি সু-নিশ্চিত উচ্চ আসনে সমাসীন করার লক্ষ্যে ছাত্রীদের পাশাপাশি শিক্ষকরাও আন্তরিকতার সাথে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন”।
বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও শিক্ষানুরাগি মো. মাহবুবুর রহমান বিদ্যালয়ের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোকিত চৌদ্দগ্রামের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় বলেন, “শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। মানসম্মত জীবন যাপনের জন্য যথার্থ জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনই হচ্ছে প্রকৃত শিক্ষা। পবিত্র কুরআন মাজীদে উল্লেখ করা হয়েছে, “ইকরা” (পড় তোমার প্রভুর নামে)। এমনি ভাবে পবিত্র কুরআন মাজীদের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার গুরুত্ব বুঝাতে মহান আল্লাহ্ অসংখ্য আয়াত নাযিল করেছেন। রাসূল (স.) এর হাদীসেও শিক্ষার গুরুত্ব বুঝানো হয়েছে বহুভাবে। শিক্ষার আবশ্যিকতা ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্রসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতীয়মান। কোন দর্শনই নারী বা পুরুষের শিক্ষার সীমানা নির্ধারণ করেনি। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে নারী শিক্ষার প্রসার আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলে এখনো সীমিত রয়ে গেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকের বেশী নারী এবং এই বিপুল জনগোষ্ঠীর কাঙ্খিত শিক্ষার সুযোগও সীমাবদ্ধ। তাই উক্ত সীমাবদ্ধতা বিবেচনা করে মেয়েদের জন্য একটি আদর্শ বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহন করি । এখানে উল্লেখ্য, আমার মা মরহুমা সৈয়দা আঞ্জুমান আরা বেগম মেয়েদের সুশিক্ষা ও ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি বিশেষ যত্নবান ছিলেন । তার মন-মানসিকতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনকল্পে, আমি তাঁর নামে এই বিদ্যালয়টি উৎসর্গ করেছি। মায়ের নামানুসারে বিদ্যালয়টির নামকরণ করা হয় “সৈয়দা আঞ্জুমান আরা বালিকা বিদ্যালয়”।
মহান আল্লাহর অসীম রহমতে গত ১জানুয়ারী ২০১৮ থেকে স্কুলটির শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে এবং প্রতিষ্ঠানটি সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে চলেছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী মানসম্মত আধুনিক শিক্ষা, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা এবং শৃঙ্খলার মাধ্যমে প্রতিটি শিক্ষার্থীর মননশীলতা এবং সৃজনশীলতা জাগ্রত করতে আমরা সদা বদ্ধপরিকর। বর্তমানে আমাদের প্রতিষ্ঠানটি শিশু শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত একটি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় হিসেবে সরকার কর্তৃক অনুমোদিত । উল্লেখ্য, কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ২০১৮ শিক্ষাবর্ষে বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রীরা জে,এস,সি পরীক্ষায় প্রথম অংশ গ্রহন করে এবং মহান আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহে শতভাগ পাশের গৌরব অর্জন করেছে। আমাদের প্রত্যাশা আগামীতেও আমাদের শিক্ষার্থীরা এরূপ গৌরবোজ্জল ফলাফল বজায় রাখবে ইনশাআল্লাহ্। নিরাপদ ও মনোরম পরিবেশে, উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন পরিচালনা পরিষদের তত্ত্বাবধায়নে কর্মদক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষক মন্ডলীর নিবেদিত প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, বিদ্যালয়টি একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান।
ইনশাআল্লাহ্, এলাকার সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ, অভিভাবকবৃন্দ, সুধীজন ও সর্বস্তরের জনগণের সার্বিক সহযোগিতায় এবং পরিচালনা পরিষদ ও শিক্ষক-কর্মচারীবৃন্দের আন্তরিক প্রচেষ্টায় বিদ্যালয়টি অচিরেই তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হবে। আল্লাহ্ আমাদের সহায় হোন”।